আত্মকর্মসংস্থান : বেকারত্ব থেকে মুক্তির অব্যর্থ অস্ত্র
প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২৫, ১২:০৬ | অনলাইন সংস্করণ
প্রজ্ঞা দাস:

বর্তমান সময়ে বেকারত্ব সমাজের অন্তস্তল থেকে জাতির অগ্রযাত্রার গতিধারাকে স্তব্ধ করে দেওয়া এক নিঃশব্দ দুর্যোগ, যা ক্রমেই অর্থনীতিকে ক্ষতবিক্ষত করছে এবং সম্ভাবনাগুলোকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে ঠেলে দিচ্ছে। বাংলাদেশ এক বিস্ময়কর সম্ভাবনার দেশ। যেখানে প্রতিটি তরুণের মধ্যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ রয়েছে, সেখানেই বেকারত্বের কষাঘাতে প্রতিনিয়ত বহু জীবন স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে।একদিকে উচ্চশিক্ষিত তরুণরা চাকরির বাজারে প্রবেশ করেও হতাশ হচ্ছে, অন্যদিকে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারা শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী আরও পিছিয়ে পরছে। এই ব্যবধানের মূল কারণ হলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা।যা কর্মসংস্থানের পরিবর্তে সনদপত্র উৎপাদনকেই বেশি অগ্রাধিকার দেয়। যার ফলশ্রুতিতে তরুণদের চাকরির জন্য হাহাকার প্রতিনিয়তই বাড়ছে। আরো একটা বিষয় হলো বেকারত্ব কেবল ব্যক্তি বা পরিবারের আর্থিক দৈন্যদশা তৈরি করে না, বরং এটি সমাজের শৃঙ্খলা ভেঙে ফেলে, অপরাধ প্রবণতাকে উসকে দেয় এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার ভিত্তি গড়ে তোলে। একজন শিক্ষিত যুবক যখন বছরের পর বছর চাকরির জন্য ঘুরতে থাকে, তখন তার মনের গভীরে ক্ষোভ জন্ম নেয়। এই ক্ষোভ ক্রমশ সামাজিক অস্থিরতায় রূপ নেয়, যার পরিণতি হয় ভয়াবহ। বেকারত্ব শুধুই একটি অর্থনৈতিক সংকট নয়; বরং এটি জাতীয় নিরাপত্তা, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং মনস্তাত্ত্বিক ভারসাম্যের ওপর এক সুক্ষ্ম অথচ গভীর আঘত।প্রতিনিয়ত সম্প্রসারিত এই সংকটের শিকড় এতটাই গভীরে প্রোথিত যে, প্রথাগত কর্মসংস্থানের ওপর নির্ভরশীলতা এখন নিতান্তই অদূরদর্শী এবং অচল পদক্ষেপে রূপ নিয়েছে। বেকারত্বের করাল গ্রাসে আত্মকর্মসংস্থান ই হতে পারে বেকারত্বের ভয়াবহ শিকল ছিঁড়ে ফেলার একমাত্র দৃপ্ত হাতিয়ার। এটি নিছক কর্মসংস্থানের প্রবাহ নয়; স্বাধীন সৃজনশীলতা, অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার পুনরুত্থান এবং আর্থ-সামাজিক মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত অভিযাত্রা।
আত্মকর্মসংস্থান মানে কেবল নিজের জন্য কাজ তৈরি করা নয়,এটি ব্যবস্থাগত অসাম্য, নিষ্ক্রিয় বাজার, এবং সীমিত পুঁজির বিরুদ্ধে এক নীরব বিদ্রোহ। প্রচলিত চাকরির ধারণা আমাদের সমাজে এতটাই গেঁথে গেছে যে আত্মকর্মসংস্থানের গুরুত্ব প্রায়শই আড়ালে রয়ে যায়। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো বাংলাদেশে ঐতিহ্যগত কর্মসংস্থান ব্যবস্থা সরকারি চাকরি, কর্পোরেট পেশা, কিংবা বিদেশমুখী শ্রম এক সীমিত কাঠামোর গণ্ডিতে আবদ্ধ।চাকরির বাজার সংকুচিত, প্রতিযোগিতা দুর্দমনীয়, আর সম্ভাবনার গণ্ডি প্রতিনিয়ত সঙ্কুচিত হচ্ছে।এই কাঠামো একটি নির্ভরশীল, অনুগত জনগোষ্ঠী তৈরি করে।যেখানে ব্যক্তি তার সৃজনশীলতা বিসর্জন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত পেশার গণ্ডিতে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে বাধ্য হয়। কিন্তু আত্মকর্মসংস্থান এর বিরোধিতা করে।এটি ব্যক্তির মধ্যে লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনাকে মুক্তি দেয়।যেখানে ব্যক্তি নিজেই তার শ্রমের নিয়ন্ত্রক, চিন্তার রূপকার এবং অর্থনীতির কারিগর হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষের ভিতরে আত্মকর্মসংস্থান বাস্তবায়ন করা এখন সময়ের দাবি। কারণ প্রচলিত চাকরির গণ্ডিতে সকলকে ঠাঁই দেওয়া সম্ভব নয়।
আত্মকর্মসংস্থান হলো নিজের শক্তিকে পুঁজি করে নতুন অর্থনৈতিক জগৎ সৃষ্টি করা।একে কেবল চাকরির বিকল্প ভাবলে ভুল হবে; বরং এটি অর্থনৈতিক মুক্তির মশাল, যা কর্মসংস্থানের দুর্দমনীয় সংকটকে প্রতিরোধ করে।আত্মকর্মসংস্থান মানে শুধু ক্ষুদ্র ব্যবসা বা দোকান চালানো নয়; এটি এক ধরনের মানসিক বিপ্লব এবং আত্মবিশ্বাসের পুনর্জাগরণ। তরুণরা যদি চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেদের দক্ষতাকে পুঁজি করে নিজস্ব কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলে, তবে কেবল বেকারত্ব কমবে না বরং একটি আত্মনির্ভরশীল অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠবে।একজন যুবক ফ্রিল্যান্সিং, স্টার্টআপ, ডিজিটাল উদ্যোক্তা, কৃষিভিত্তিক উদ্যোগ, কিংবা শিল্পোদ্যোগের মাধ্যমে কেবল নিজের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করেন না; তিনি আরও দশজনের জন্য কর্মসংস্থানের পথ উন্মুক্ত করেন। ফলে আত্মকর্মসংস্থান হলো একটি গুনিতক প্রক্রিয়া। যা ব্যক্তি থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র সর্বত্র ইতিবাচক পরিবর্তন আনে। আত্মকর্মসংস্থানের নীতি যেহেতু এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশে অনেকটাই পশ্চাৎপদ ,তাই আত্মকর্মসংস্থানকে বাস্তবায়নের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া অতীব জরুরী।প্রতিটি অঞ্চলে ‘সৃজনশীল উদ্যোগ কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করতে হবে।যেখানে তরুণদের নতুন আইডিয়া, স্টার্টআপ পরিকল্পনা, এবং ব্যবসায়িক কৌশল শাণিত হবে। এটি হয়ে উঠবে চিন্তার উৎকর্ষ সাধনের স্থান। কেননা কার্যকারী আইডিয়ার জাগরণই সফল আত্মকর্মসংস্থানের মূল চালিকাশক্তি। শুধু সুন্দর আইডিয়াই নয় যেকোনো কিছু শুরু করতে অর্থেরও প্রয়োজন।তাই সরকারি এবং বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগে স্বল্প সুদের বিশেষ ঋণ প্রকল্প চালু করা দরকার, যাতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সহজেই নতুন কিছু শুরু করার জন্য মূলধন পেতে পারেন। পাশাপাশি প্রতিটি উপজেলায় প্রযুক্তি ও ব্যবসায়িক দক্ষতার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে তরুণদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য প্রস্তুত করতে হবে এবং ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, বিপণন কৌশল এবং প্রশাসনিক জটিলতা দূরীকরণে সহায়তা করতে হবে। উদ্যোক্তাবান্ধব নীতি বাস্তবায়ন না হলে আত্মকর্মসংস্থান থমকে যাবে। ব্যবসা শুরু করার জন্য সহজ রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি, বিনিয়োগ সুরক্ষা, এবং আইনি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। তদুপরি, কর ব্যবস্থায় তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য প্রণোদনামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্কিং এবং মেন্টরশিপ ব্যবস্থা আত্মকর্মসংস্থানকে আরো উৎসাহিত করতে পারে। অভিজ্ঞ উদ্যোক্তাদের সঙ্গে তরুণদের সংযোগ স্থাপন, কনফারেন্স, ওয়ার্কশপ এবং উদ্যোক্তা এক্সপো আয়োজন আত্মকর্মসংস্থান সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করবে।সর্বোপরি সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন তা হলো আমাদের দেশের প্রতিটি জনগণের ভেতরে মানসিকতার পরিবর্তন আনা। কেননা আমাদের সমাজে এখনও পর্যন্ত কাঠামোগত চাকরিকে সাফল্যের চূড়ান্ত প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। এ ধারনা বদলাতে হবে। আত্মকর্মসংস্থানকে 'বিকল্প' পেশা নয়, বরং 'সেরা' পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের স্কুল পর্যায় থেকেই উদ্যোক্তা মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। তবেই দেশ এগিয়ে যাবে অপার গতিতে।
বেকারত্বের করাল গ্রাস থেকে মুক্তির পথ আত্মকর্মসংস্থানের মধ্যেই নিহিত।তাই আমাদের সকলকে বেকারত্বের কুহেলিকা ছিন্ন করে আত্মকর্মসংস্থানের বজ্রনিনাদে গর্জে উঠতে হবে এবং আত্মকর্মসংস্থানের মশাল জ্বালিয়ে বেকারত্বের আঁধারকে চূর্ণ করে উদ্ভাসিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারলেই বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সাধিত হবে। বাংলাদেশকে উন্নত, সমৃদ্ধশালী এবং প্রগতিশীল রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হবে এবং বাংলাদেশ হয়ে উঠবে উন্নয়নের রোলমডেল।
লেখক : শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ।
আমার বার্তা/জেএইচ