দেশের বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলো (টিটিসি) নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর স্ববিরোধী কর্মকাণ্ড এবং দ্বিচারিতা করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ মতে, দেশের লাল তালিকাভুক্ত ২৩টি শিক্ষক প্রশিক্ষণ (টিটি) কলেজকে সুবিধা দিতে খোদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের আইন শাখার একজন কর্মকর্তা আদালতের আদেশের ভুল ব্যাখ্যা করে কৌশলে এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।
অভিযোগে জানা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ অধিভুক্তির শর্ত ও প্রশিক্ষণের গুণগত মান রক্ষা করতে না পারায় ২০০৮ সালে ৩৭টি বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজকে লাল তালিকাভুক্ত করে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধের সুপারিশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কলেজগুলোকে অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই আদেশে সংক্ষুব্ধ হয়ে লাল তালিকার ২৩টি কলেজ আদালতের শরণাপন্ন হয়। ২০০৮ সালের মামলাটি সময় গড়িয়ে ২০১৫ সালে একটি আদেশ দেন আদালত। আদেশে ২০০৮ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত মামলা চলাকালীন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২৩টি কলেজ থেকে যারা পাস করেছেন তাদের অর্জিত সনদ বৈধ ঘোষণা করা হয়। তবে এই আদেশে কলেজগুলোর কার্যক্রম বৈধ নাকি অবৈধ কিংবা ভবিষ্যতে এসব কলেজ শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবে কিনা, প্রশিক্ষণার্থী ভর্তি করাতে পারবে কিনা, তার কোনও সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়নি আদালত।
আর এই সুযোগ নিয়ে ২৩টি লাল তালিকাভুক্ত কলেজের মালিক পক্ষ হাইকোর্টের আদেশের ভুল ব্যাখ্যা করে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের কাছে অত্যন্ত কৌশলে তা উপস্থাপন করে। এরপর মন্ত্রণালয় অফিস আদেশ জারি করে লাল তালিকাভুক্ত কলেজগুলোর পক্ষে।
মন্ত্রণালয়ের ২০১৬ সালের ২৮ জানুয়ারির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্ম-সচিব ডা. মো. ফারুক হোসেনের সই করা অফিস আদেশে বলা হয়, ‘মূল রিট মামলার রায়ের আলোকে মন্ত্রণালয়ের ২০০৮ সালের ১৫ মে জারি করা পত্রের কার্যক্রম আপিল শুনানির পরবর্তী তারিখ পর্যন্ত স্থগিত রাখায় মূল রিট মামলার বাদীদের প্রতিষ্ঠান থেকে বিএড সনদ অর্জিত স্কেল প্রদানের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হলো।’ শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই নির্দেশনা দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালককে।
এই অফিস আদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের ২০১৯ সালের অফিস আদেশে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারদের একধাপ এগিয়ে উল্টো আদেশ জারি করে। অফিস আদেশে বলা হয়, ‘২০১৬ সালের মন্ত্রণালয়ের জারি করা পত্রের আলোকে ২৩টি টিচার ট্রেনিং কলেজের বাইরে অন্য কোনও টিচার ট্রেনিং কলেজ থেকে অর্জিত সনদের বিপরীতে বিএড স্কেল প্রদান না করার জন্য অনুরোধ করা হলো। ইতোমধ্যে প্রদান করা হয়ে থাকলে তার তথ্যাদি অধিদফতরে দাখিলের অনুরোধ করা হলো।
এতে লাল তালিকাভুক্ত টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলোর বাইরে থাকা মানসম্মত টিটি কলেজগুলো শিক্ষার্থী সংকটে পড়ে। আর লাল তালিকাভুক্ত কলেজগুলো অতিরিক্ত প্রশিক্ষণার্থী ভর্তি করার সুযোগ পায়।
বিষয়টি এখানেই থেমে থাকেনি। ২০১৯ সালের চিঠির পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ২০২১ এবং ২০২২ একই রকম দুটি অফিস আদেশ জারি করা হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সহকারী সচিব মো. আব্দুল জলিল মজুমদারের সই করা অফিস আদেশে বলা হয়, ‘সুপ্রিম কোর্টের আপিল মামলা নিষ্পত্তির আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং কনটেম্পট পিটিশন বহালের পরিপ্রেক্ষিতে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার আলোকে ২৩টি কলেজের নামের তালিকা প্রকাশপূর্বক পত্র জারি করা প্রয়োজন।
অফিস আদেশে দুটিতে আরও বলা হয়, রায়ের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি ২৩টি কলেজের অর্জিত সনদধারী শিক্ষকগণের বিএড স্কেল প্রদানের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের ২০১৬ সালের ২৮ জানুয়ারির জারি করা পত্রটি বাস্তবায়নের জন্য অনুরোধ করা হলো।
যতবার মন্ত্রণালয় অফিস আদেশ জারি করে ততবার ২৩টি কলেজের নামের তালিকা দিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর থেকে অফিস আদেশ জারি করা হয় জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারদের নির্দেশনা দিয়ে। তাতে বলা হয়, ‘২০১৬ সালের মন্ত্রণালয়ের জারি করা পত্রের আলোকে ২৩টি টিচার ট্রেনিং কলেজের বাইরে অন্য কোনও টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে অর্জিত সনদের বিপরীতে যে বিএড প্রদান স্কেল প্রদান না করার জন্য অনুরোধ করা হলো। ইতোমধ্যে প্রদান করা হয়ে থাকলে তার তথ্যাদি অধিদফতরে দাখিলের অনুরোধ করা হলো।
এই পরিস্থিতিতে বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ শিক্ষক সমিতি মন্ত্রণালয়ে এর প্রতিবাদ জানালে ২০২১ ও ২০২২ সালের দুটি চিঠি বাতিল করে মন্ত্রণালয়। ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয় চিঠি বাতিলের আদেশ জারি করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরকে জানায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত বেসরকারি টিটি কলেজের হালনাগাদ তালিকা ও লাল ক্যাটাগরিভুক্ত বেসরকারি বিএড কলেজের তালিকা জরুরি ভিত্তিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে আপলোড করে এ বিভাগকে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হলো।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশ বাস্তবায়নে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি ও বেসরকারি মিলে মোট অধিভুক্ত ৯০টি কলেজের তালিকা প্রকাশ করে ২০২৪ সালের ২ জানুয়ারি। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকারি ১৪টি এবং বেসরকারি ৭৬টি মোট ৯০টি বিএড কলেজের অবকাঠামো ও শিক্ষক সংখ্যার তারতম্য থাকলেও অভিন্ন কারিকুলাম অনুযায়ী পাঠদান ও কোর্স সমাপন শেষে অভিন্ন পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা ডিগ্রি অর্জন করে বিধায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জিত সনদের মান সর্বক্ষেত্রে সমান।
এই পরিস্থিতিতে দেশের সব বেসরকারি কলেজগুলো শৃঙ্খলায় থাকলেও আবারও নতুন করে স্ববিরোধী কার্যক্রম এবং দ্বিচারিতা শুরু করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলোয় বিএড প্রশিক্ষণার্থী ভর্তির মৌসুম শুরুর আগে ২০২৫ সালের ২১ জানুয়ারি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ আবার অফিস আদেশ জারি করেন। ২০২১ ও ২০২২ সালের যে চিঠি মন্ত্রণালয় ২০২৩ সালে বাতিল করে সেই চিঠি নতুন করে আবার জারি করা হয়। মন্ত্রণালয়ের সেই সহকারী সচিব মো. আব্দুল জলিল মজুমদারের সই করা চিঠিতে আবার বলা হয়, ‘‘২০১৬ সালের মন্ত্রণালয়ের জারি করা পত্রের আলোকে ২৩টি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের বাইরে অন্য কোনও টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে অর্জিত সনদের বিপরীতে যে বিএড প্রদান স্কেল প্রদান না করার জন্য অনুরোধ করা হলো। ইতোমধ্যে প্রদান করা হয়ে থাকলে তার তথ্যাদি অধিদফতরে দাখিলের অনুরোধ করা হলো।’
এই বিষয়ে জানতে চাইলে আদেশে স্বাক্ষরকারী কর্মকর্তা সহকারী সচিব আব্দুল জলিল মজুমদার বলেন, আমি প্রধান উপদেষ্টার প্রোগ্রামে আছি। পরে ফোন দেবেন।’ কতক্ষণ পর ফোন দিতে হবে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
এ বিষয়ে সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সহকারী সচিব আব্দুল জলিল মজুমদার ভর্তির সময় আসলেই লাল তালিকাভুক্ত কলেজের তালিকা দিয়ে আদেশ জারি করার প্রক্রিয়া শুরু করেন। মন্ত্রণালয় নিজেদের আদেশ বাতিল করলেও নতুন করে ফাইল উঠিয়ে লাল তালিকাভুক্ত ২৩টি কলেজের পক্ষে অবস্থান নেন তিনি। এই পরিস্থিতিতে আমরা বাধ্য হয়ে লিগ্যাল নোটিশ করেছি। নোটিশের জবাব পেলে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করবো উচ্চ আদালতে।
অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আদালতের আদেশের ভুল ব্যাখ্যা করে বারবার সহকারী সচিব আব্দুল জলিল মজুমদার আদেশ জারি করছেন। এ কারণে সহকারী সচিব আব্দুল জলিল মজুমদারসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করে আদালত অবমাননার মামলা করা হবে। সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন
আমার বার্তা/এমই