
শুক্রবার মুসলমানদের জন্য সপ্তাহের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। ইবাদত, নামাজের জন্য মসজিদে একত্রিত হওয়া, দোয়া ও আত্মশুদ্ধির বিশেষ সুযোগ এনে দেয় এই দিন। কোরআন ও হাদিসে শুক্রবারের যে ফজিলত ও গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে, তা অন্য কোনো দিনের সঙ্গে তুলনাহীন।
শুক্রবারই মুসলমানরা একত্রে সমবেত হয়ে জুমার নামাজ আদায় করেন। নামাজের আগে খুতবার মাধ্যমে আল্লাহ, ইসলাম ও মানবজীবন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা শোনা হয়, যা ঈমানকে মজবুত করে এবং জীবন পরিচালনায় শক্তি জোগায়।
ইসলামের দৃষ্টিতে একজন মুমিনের পুরো জীবনই ইবাদত। এমনকি আনন্দ ও উদযাপনও হয় আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। যদিও আল্লাহর ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট কোনো স্থান বা সময় বাধ্যতামূলক নয়, তবুও কিছু সময় ও দিনকে আল্লাহ বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। শুক্রবার তেমনই একটি দিন।
হাদিস থেকে জানা যায়, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে উত্তম দিন হলো শুক্রবার, যা সমবেত নামাজের দিন। এ দিন মুসলমানরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক আল্লাহর ইবাদত করেন এবং নিজেদের ঈমান ও আনুগত্য নতুন করে দৃঢ় করেন।
পুরুষদের জন্য জুমার নামাজ আদায় করা ফরজ। সমবেত নামাজ ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিধান। বাংলাদেশসহ অনেক মুসলিমপ্রধান দেশে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হলেও নামাজের সময় ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ রাখা বাধ্যতামূলক নয়। পশ্চিমা দেশগুলোতে বসবাসকারী মুসলমানরা সাধারণত দুপুরের বিরতিতে জুমার নামাজ আদায়ের চেষ্টা করেন।
হাদিসে এসেছে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ এবং এক জুমা থেকে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সংঘটিত ছোট গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেওয়া হয়, যদি কেউ বড় গুনাহে লিপ্ত না হয়। তাই কাজ, পড়াশোনা বা দুনিয়াবি ব্যস্ততার অজুহাতে জুমার নামাজ অবহেলা করা একজন মুসলমানের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। পরপর তিনবার কোনো বৈধ কারণ ছাড়া জুমা ছেড়ে দিলে মানুষ সরল পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় পড়ে।
যদিও জুমার নামাজ পুরুষদের জন্য ফরজ, তবে এই দিনে নারী, পুরুষ ও শিশু সবার জন্যই আমলের সুযোগ রয়েছে। গোসল করা, পরিষ্কার কাপড় পরা, বেশি বেশি দোয়া করা, নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর দরুদ পাঠ করা এবং কোরআনের ১৮ নম্বর সুরা, সুরা কাহাফ তিলাওয়াত করা এই দিনের গুরুত্বপূর্ণ আমল।
হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, শুক্রবার এমন একটি সময় রয়েছে, যখন আল্লাহর কাছে দোয়া করলে তা কবুল হয়। এই সময়টি আসরের পর দিনের শেষ ভাগে অনুসন্ধান করতে বলা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি শুক্রবার সুরা কাহাফ তিলাওয়াত করে, তাকে পরবর্তী শুক্রবার পর্যন্ত বিশেষ নুর দান করা হয়।
শুক্রবারের গুরুত্ব আরও বোঝা যায় মানব ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর মাধ্যমে। এই দিনেই আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়, জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়, সেখান থেকে দুনিয়ায় প্রেরণ করা হয় এবং তার ইন্তেকালও হয়। কিয়ামতও সংঘটিত হবে শুক্রবারেই।
কোরআনের একটি মহান আয়াতও এই দিনে নাজিল হয়, যেখানে আল্লাহ বলেন, আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম, আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য জীবনব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম।
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাবের জীবনের একটি ঘটনা শুক্রবারের মর্যাদা আরও স্পষ্ট করে। এক ইহুদি আলেম তাকে বলেছিলেন, কোরআনের এই আয়াত যদি তাদের ওপর নাজিল হতো, তবে তারা সেই দিনটিকে প্রতি বছর উৎসব হিসেবে পালন করত।
ইসলামি চিন্তাবিদ ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.) বলেন, আলেমদের ঐকমত্য অনুযায়ী সপ্তাহের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হলো শুক্রবার। তার ছাত্র ইবনুল কাইয়্যিম তার গ্রন্থে শুক্রবারের ৩২টি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন।
হাদিসে শুক্রবারকে মুসলমানদের জন্য ঈদের দিন হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে। তাই এই দিন আল্লাহ যে অফুরন্ত রহমত ও বরকত নাজিল করেন, তা কাজে লাগানো একজন মুমিনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুক্রবার একদিকে যেমন সমবেত ইবাদতের দিন, তেমনি এটি আত্মচিন্তা, দোয়া ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের বিশেষ সুযোগের দিন।

